সমস্ত লেখাগুলি

রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম, একটি যুক্তিবাদী অনুসন্ধান -
অভিষেক ঘোষ
May 20, 2025 | যুক্তিবাদ | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রথম পর্ব: 

দক্ষিণেশ্বরের পুরোহিত গদাধর, রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়,  স্ত্রী সারদাদেবীকে বলেছিলেন, একশ বছর পর আবার আসবেন অর্থাৎ তাঁর পুনর্জন্ম হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে সারদাদেবী  বলেন “ঠাকুরের থাকবে সন্ন্যাসীর বেশ। তিনি যে বাউল বেশে আসবেন বলেছেন। বাউলবেশ - গায়ে আলখাল্লা, মাথায় ঝুঁটি, এতখানা দাড়ি। বললেন, বর্ধমানের রাস্তায় দেশে যাব, পথে কাদের ছেলে বাহ্য করবে, ভাঙা পাথরের বাসন হাতে, ঝুলি বগলে।” কথাগুলি প্রকাশিত হয়েছে উদ্বোধন কার্য্যালয় এর শ্রীশ্রীমায়ের কথায়। 


আমরা শুনেছি, ভক্তরা বলে থাকে ব্রহ্মবাক্য নাকি মিথ্যা হবার নয়। তারপর আস্ত ভগবান  অবতারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গদাধরের বাক্য কখনও মিথ্যা হতে পারে একথা তো ভাবাই বাতুলতা! 

আমরা যুক্তিবাদী। সব কিছু যুক্তি ও প্রশ্ন দিয়ে যাচাই করা আমাদের কাজ। তা গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর হয়েছে ১৮৮৬ সালে। অবতারবরিষ্ঠ গদাধরের কথা সেই সঙ্গে ‘জগৎমাতা’ সারদার কথা যদি ব্রহ্মবাক্য হয় তাহলে একশো বছর, অর্থাৎ কিনা ১৯৮৬ সালে তাঁর পুনর্জন্ম হবার কথা। এবং বাউলবেশে, ঝুলি বগলে, বর্ধমানের রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার কথা। আজকে ২০২৩ এ তাঁর বয়স হওয়া উচিৎ  ৩৭ বছর। কই,আজ পর্যন্ত তো এরকম কোন বাউলকে দেখা গেল না! 

এ তো গেল গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের নিজমুখে পুনর্জন্ম নেবার প্রথম অঙ্গীকার। দ্বিতীয় অঙ্গীকারও  তিনি করেছেন কিন্তু! অন্নদাঠাকুর, স্বপ্নজীবন গ্ৰন্থে লিখেছেন রামকৃষ্ণ তাকে বলেছেন - “তোমার ভয় নেই, দেহরক্ষার বত্রিশ বছর পর আমি আবার বাংলায় যাচ্ছি। সেই দেহরক্ষার সত্তর বছর পর আবার, এইভাবে আরও এগারো বার অবতীর্ণ হব।”  রামকৃষ্ণর এত নিকট ভক্তকে দেওয়া তাঁর কথা কি মিথ্যা হতে পারে!  সেই হিসেবে ১৮৮৬ + ৩২ অর্থাৎ  ১৯১৮ সালে রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম হবার কথা এবং বর্তমানে তাঁর বয়স হওয়া উচিত নয় নয় করে ১০৫। (কত বছর বেঁচে থাকবেন বলেননি,অবতার মানুষ সবই সম্ভব।)


রামকৃষ্ণ মিশনকে তো এখনও পর্যন্ত তাদের পরম আরাধ্যের নবকলেবর খোঁজার জন্য বিন্দুমাত্র তাগিদ নিতে দেখা গেল না! কারণ কী? রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ কি স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবের কথায় বিশ্বাস করে না?  নাকি নব্য জ্ঞানের আলোকের তাঁরা পুনর্জন্ম, জন্মান্তর এসব কিছুতে আস্থা হারিয়েছে?  দ্বিতীয়টি least possible, কারণ মিশন কোন ছার  জগতের কোন প্রাতিষ্ঠানিক  ধর্মই আত্মা, পরলোকবাদ, জন্মান্তরের কথা না বলে নিজেদের ধর্মপ্রচার চালাতে পারবে না। ধর্ম জিনিসটাই দাঁড়িয়ে আছে ইহলোক পরলোক, পাপের ভয়, জন্মান্তরের সুখের ওপর। তাহলে কি প্রথমটিই ঠিক? অবশ্য আরেকটা কারণ হতে পারে মিশন প্রকাশিত বইগুলি মিশনের  লোকজনই ভাল করে পড়ে দেখেনি! নাহ, এটাও মনে হয়না। এগুলো পাঠক্রমের অধ্যবসায়ে ওদের পড়তে হয়। তাহলে দাঁড়াল কী?  মিশন সব জেনেও, না জানার ভান করে আছে। যুক্তিবাদী  প্রবীর ঘোষ  লিখছেন - “সারদা মা’র প্রতি রামকৃষ্ণদেবের এই ধরণের বক্তব্যকে বর্তমানে মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে অসার মনে হলে মিশন কর্তৃপক্ষের কি নৈতিক দায়িত্ব ছিল না, এই বিষয়ে মতামত স্পষ্টভাবে ভক্তদের কাছে ব্যক্ত করা?  নাকি রামকৃষ্ণদেবের নবকলেবর আবির্ভাব বিষয়ে নীরবতার পিছনে ক্রিয়াশীল রয়েছে অর্থ ও কর্তৃত্ব হারাবার শঙ্কা?”

একবার ভেবে দেখুন রামকৃষ্ণ যদি হঠাৎ এই তৃণমূল-বিজেপি অলঙ্কৃত বাংলায় আবির্ভূত হয়ে মিশনের যাবতীয় সম্পত্তির (ইনটেলেকচুয়াল ও ফিজিকাল) অত্যন্ত সঙ্গত অধিকার দাবি করে বসেন তাহলে কী কী হতে পারে! তাই কি মিশন কর্তৃপক্ষ উক্ত ভবিষ্যতবানীটি নিয়ে কথা বলতে নারাজ?  


১৯৮৯ সালের ২৭ আগস্ট  প্রবীর ঘোষ গিয়েছিলেন বেলুড় মঠে স্বামী  ভূতেশানন্দের কাছে এবং এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাতে উত্তরের পরিবর্তে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন, তাঁর সচিব উন্মত্তের মত রাগ প্রকাশ করে প্রবীর ঘোষের ওপর। সম্ভবত সব ভক্তিবাদী যুক্তিহীনদের মতই  উত্তর দিতে না পারার ব্যর্থতা ক্রোধ হিসেবে প্রকাশ পায়। 



দ্বিতীয় পর্ব: 

সারদাদেবী ও অন্নদা ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরের পূজারী বামুন রামকৃষ্ণ বলেছিলেন তিনি আবার জন্ম নেবেন। হ্যাঁ  সময়ের হেরফের ছিল, কিন্তু জন্ম যে নেবেন এ’কথা স্থিরনিশ্চিত। রামকৃষ্ণের নামে চলা সংস্থা, রামকৃষ্ণ মিশনের এই নিয়ে কোনরকম মাথাব্যথা দেখি না। অন্য কথায় স্বয়ং রামকৃষ্ণকথিত ব্রহ্মবাক্যকেই তারা অগ্ৰাহ্য করেছে, এবং রামকৃষ্ণের নবকলেবর সন্ধানে সচেষ্টতা দেখায়নি। 

রামকৃষ্ণের নবজন্ম নিয়ে মিশন মাথাব্যথা না করলেও অনেকেই কিন্তু করেছে। ১০ জুলাই ১৯৮৭ সালে যোগী যোগানন্দ সর্বতীর্থ নামে এক ব্যক্তি, বর্ধমানের একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এক এফিডেবিট করে দাবি করেন - “ যুগাবতার শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব লীলা সংবরণ করার পর পুনরায় নবকলেবরে সপার্ষদ একশত বৎসর গতে অবতীর্ণ হওয়ার বৃত্তান্ত আমি অপ্রাকৃতিক জ্ঞানচক্ষু দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়াছি এবং তাহাদের বর্তমান স্থুল শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বা সংস্থা গ্ৰহণ করলে আমি তাঁহাদের শনাক্ত করিতে সক্ষম, ইহা আমার জ্ঞান মতে সত্য।”

শুধু এফিডেবিট করে থেমে না থেকে তিনি চিঠি লিখেছেন মিশনের গম্ভীরানন্দকে। যোগানন্দের কথায় তিনি দৈব আদেশে রামকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুযায়ীই জনগণকে জানাতে চান রামকৃষ্ণ সপার্ষদ জন্মেছেন। তিনি নিজে নাকি গতজন্মে ছিলেন রামকৃষ্ণ পার্ষদ লাটু /অদ্ভুতানন্দ। গানন্দ, মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াও কলকাতায় প্রবীর ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যাতে তিনি যুক্তিবাদী সমিতিকে সঙ্গে নিয়ে এই বিষয়ের তদন্তে নামেন। 


বলা বাহুল্য  তাঁর এই ‘মহতী’ প্রয়াসে রামকৃষ্ণ মিশন গা করেনি। 

অন্য এক ব্যক্তি, ইনিও বর্ধমানের বাসিন্দা, যোগী তিমিরবরণ, রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতির কাছে এক লিখিত আবেদন রাখেন, ১৬ নভেম্বর, ১৯৮৭ তে। বিস্তারিত আবেদনটিতে আরও অনেক কথার সঙ্গে,  তিনি বলেন রামকৃষ্ণ মিশন যদি মনে করে রামকৃষ্ণের বাক্য ব্রহ্মবাক্য তাহলে তাদের উচিত রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম বিষয়ে অনুসন্ধান করা। তিনি এও জানান, রামকৃষ্ণ কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেদিন পঞ্চবটীর ডাল ভেঙে আসনে পড়বে, সেদিন তিনি আবার জন্ম নেবেন,আজ ৬৫ বছর হল ডালটি ভেঙে পড়েছে কিন্তু কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি খেদ প্রকাশ করেন এই বলে যে,  “পুনরাবির্ভাবের যদি মূল্যায়ন না হয় তাহলে হয় রামকৃষ্ণ তত্ত্ব মিথ্যা, নয়তো মিশনের আধিকারিকরা দিব্যচক্ষুর অধিকারী নয়, অথবা হয়তো সব জেনেই তারা গদীর মোহে আকৃষ্ট থেকে ঠাকুরকে লোক সমক্ষে প্রতিষ্ঠা করছে না।”

 

প্রসঙ্গত পঞ্চবটীর ডাল ভেঙ্গে যাওয়া এবং রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম নেবার কথাটি অন্নদাঠাকুর তার আত্মজীবনী ‘স্বপ্নজীবনে’ও বলেছেন। রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম নিয়ে তদন্ত করতে প্রবীর ঘোষ বর্ধমান যান ১৯৮৯ সালে। আশ্চর্যজনক ভাবে এখানে উনি দু’জনের দেখা পান যাদের দাবি তারাই রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম!  


প্রথমজন ভোলানাথ অধিকারী, জন্ম ১৯৩৪। একমুখ গোঁফ দাড়ি, কথায় গ্ৰাম্য ছোঁয়া। আলাভোলা ভাব। প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান - “রামকৃষ্ণ-ই যে রামকৃষ্ণ, সেটা আবার রামকৃষ্ণ কেই প্রমাণ করতে হবে!  ভারি মজার তো!  রামকৃষ্ণ মিশন!  আমার নামে মিশন!  ওরা তো সব মরছে গু ঘেঁটে। মরুক ওরা ক্ষমতা আর ভোগ নিয়েই। আমাকে নিয়ে গেলে ওদের সব এক একটাকে (ছাপার অযোগ্য)...”


দ্বিতীয়জন নীলমণি বন্দোপাধ্যায়। হোমিওপ্যাথি করেন। ইনিও বর্ধমানের বাসিন্দা। দরিদ্র। রামকৃষ্ণের মত দাড়ি। প্রশ্নের উত্তরে তাঁর গলাতেও একই সুর। “আমি যে গত জন্মে রামকৃষ্ণ ছিলাম এ’কথা প্রমাণ দিতে পারি। নিয়ে আসুন রামকৃষ্ণ মিশনের মাথাদের, আমার নাম ভাঙিয়ে যারা করে কম্মে খাচ্ছে। ওইসব ক্ষমতালোভী, অর্থলোভীগুলোকে আমি বিশ্বাস করি না। ওরা কখনওই আসবে না।” কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন তিনি যে রামকৃষ্ণ তা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন রাজীব গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, বরুণ সেনগুপ্ত ইত্যাদিদের। তাঁর বাড়ির ছয় ফুট নীচে নাকি রয়েছে শিব মন্দির, তাতে শিবলিঙ্গ ও মোহর ভর্তি ছয়টা সোনার ঘড়া। বাড়ির দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো তিনটি ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে উনি তন্ত্র, মুসলিম ও খ্রীস্টান মতে সাধনা করছেন। “মিশনকে জানাব, তারা এসে পরম সমাদরে ঘড়া সমেত আপনাকে নিয়ে যাবে” বলে বেরিয়ে পড়েন প্রবীর ঘোষ। 


এখন যুক্তিবাদীদের খুব ছোট্ট একটি প্রশ্ন রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে, “ব্রহ্মবিদ”, “অবতারবরিষ্ঠ” মিশনের পরমারাধ্য রামকৃষ্ণদেবের “দৈববাক্য” কে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে, মিশন কবে রামকৃষ্ণদেবের নবকলেবরকে ‘সপার্ষদ’ মিশনে এনে সশ্রদ্ধায়  বরণ করবে? নাকি তারা আগের মতই প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে তাদের পরমারাধ্যেরই বাক্যে চূড়ান্ত অবিশ্বাস  প্রমাণ করবে?  জানার অপেক্ষা রইল। 


সহায়ক গ্ৰন্থ;

১.স্বপ্নজীবন 

২. অলৌকিক নয় লৌকিক চতুর্থ খন্ড


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর - রামকৃষ্ণ, একটি ‘অসফল’ সাক্ষাৎকার -
অভিষেক ঘোষ
Nov. 25, 2024 | যুক্তিবাদ | views:900 | likes:2 | share: 2 | comments:0

পর্ব – ১

কামারপুকুর থেকে আগত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ গদাধর চট্টোপাধ্যায় তখন কলকাতায় এক পরিচিত নাম। তিনি প্রায়শই  'বড় মানুষদের' সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্ৰহী হন। তাদের বাজিয়ে দেখতে চান।  নিজের কষ্ঠিপাথরে, অন্য কথায় ধার্মিকতার  কষ্ঠিপাথরে তাদের বিচার করতে চান।  কথামৃতকার শ্রীম তার ভক্ত। তাকে তিনি প্রকাশ করেছেন  ঈশ্বর বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা। বিদ্যাসাগর অবশ্য পূজারী বামুনটি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তাঁর কর্মপরিধি ধর্মকুসঙ্গ থেকে বহুদূরের। কেবল জিজ্ঞাসা করলেন শ্রীম কে "কীরকম পরমহংস? তিনি কি গেরুয়া কাপড় পরে থাকেন?"  যাই হোক  শ্রীম, যিনি তখন বিদ্যাসাগরের বিদ্যালয়ে কর্মরত এক শিক্ষক, নিয়ে গেলেন তার প্রাণের ঠাকুর রামকৃষ্ণকে বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাসগৃহে। বিদ্যাসাগর- গদাধরের  সাক্ষাৎ হল 5 অগস্ট, 1882 ।


বিদ্যাসাগর তাঁর স্বভাব অনুযায়ী ভদ্র ও সুন্দর ব্যবহার করলেন গদাধরের সঙ্গে। তাঁকে বর্ধমানের মিষ্টি খেতে দিলেন। গদাধর তার স্বভাব অনুযায়ী ধর্মকথায় খই ফোটালেন। একথা সেকথা। সবই একই বিষয়ে ঘোরাঘুরি। কথামৃত পড়লে জানা যায় গদাধরের প্রবচনপ্রিয়তা।  বিদ্যাসাগর সম্পর্কেও  কিছু ভাল ভাল কথা বললেন, "তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, বিদ্যার সাগর" ইত্যাদি। বিদ্যাসাগরের দয়া করুণার প্রশংসা করলেও ঠারেঠোরে বোঝাতে চাইলেন এসব ঠিক আছে তবে আসলে ঈশ্বরের কথা না ভাবলে সব মাটি। অর্থাৎ কিনা একমাত্র গদাধরের পথটিই অবলম্বনীয়। তিনি যা করছেন তার কাছে এসব দান দয়া সব ফিকে। এসব সারবত্তাহীন  ভাবের কথার থেকে মানুষের অভাব যাকে বেশি বিচলিত করতো সেই কর্মবীর মানুষটি 16 বছরের ছোট এক অশিক্ষিত পুরোহিতের কথা কিভাবে নিয়েছিলেন অনুমান করা কঠিন নয় তবে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। বরং   "সাগরে এসে মিললাম"  এর উত্তরে মজার ছলে, "তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান" বলেছেন। কথামৃতে এই সাক্ষাৎকারে কথোপকথনের সিংহভাগ জুড়ে আছে গদাধরের মুখঃনিঃসৃত কথাবার্তা, অন্য কথায় সেই চেনা ধর্মীয় বুলি,যা আছে কথামৃতের সর্বত্র। বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করেছেন - "তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?" পাঠক এই প্রশ্নটি মনে রাখুন। এই প্রশ্নের উত্তর থেকে পরে গদাধরের মনোজগতের একটি পরিচয় পাওয়া যাবে। 


উত্তরে গদাধর জানান নিশ্চয়ই তাই। তাতে বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসছেন।  পাঠক লক্ষ্য করুন, বিদ্যাসাগর প্রায় সমস্ত সময়টাই গদাধরকে নিচ্ছেন হালকা মনে। সহাস্যআননে। গম্ভীর তত্বকথা যা ভাবাতে পারে, তাতে মানুষের আচরণ এরকম হয় না। গদাধরের বচনামৃত যে তাঁর মনে রেখাপাত করছে না, (বা পরেও করেনি) তার প্রমাণ পাতায় পাতায়। 

গদাধর বলছেন "তাকে পান্ডিত্য দিয়ে বিচার করে জানা যায় না।"  (বিদ্যাসাগর পন্ডিত ব্যক্তি বলেই কি তার সামনে  এই জাতীয় কথাপ্রসঙ্গ ?) এর মধ্যে  মাঝেমধ্যে তিনি ভাবাবিষ্ট হচ্ছেন। কখনো মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের ভাষায় 'সমাধিমন্দিরে' চলে যাচ্ছেন।  


এসব পর্বের পর গদাধর বিদ্যাসাগর কে বললেন  "একদিন বাগান দেখতে যাবেন, রাসমণির বাগান"। তাতে বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তা যে কেবল কথার কথা ভদ্রতা ছিল, আমার জানতে পারি তিনি কখনোই রাসমণির বাগান দেখতে না যাওয়ায়।  পাঠক এই প্রসঙ্গটিও মনে রাখুন।  


বেশ কিছুক্ষণ ধরে ধর্মপ্রসঙ্গ করবার পর (অবশ্য কথামৃতে বহু কথার সংযোজন শ্রীমর, এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা যাবে)  গদাধর বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন এখানে ঠিক হালে পানি পাওয়া যাবে না। 


এটি বিদ্যাসাগর - গদাধরের প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎকার। 

যৌক্তিক দৃষ্টিতে ভাবাটা বোধহয় অসঙ্গত নয় যে তৎকালীন সমাজে গদাধর চট্টোপাধ্যায় নানান লোকের তোল্লাই পেয়েছিলেন। নিজেকেই স্বয়ং অবতার বা ভগবান ভেবেছিলেন কিনা জানি না তবে ভগবান সম্পর্কে তিনি যে একজন authority এই বোধ বেশ দৃঢ় ভাবেই তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। শুধুমাত্র উক্ত সাক্ষাৎকারটি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলেই তা বেশ বোঝা যায়।  তিনি অন্যদের চেয়ে বেশ কিছুটা আলাদা (যদিও নিজেকে বহুক্ষেত্রে অধম বলে বিনয় করেছেন) সেই ধারণাও তার অবশ্যই হয়েছিল। 


পর্ব – ২

নিজের আগ্ৰহেই যখন  গদাধর চট্টোপাধ্যায় কলকাতার তৎকালীন নামী মানুষদের সঙ্গে যেচে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন, নিজের ধর্মে তাদের ভজানোর জন্যই হোক বা 'বড় মানুষ' দেখার ঐকান্তিক আগ্ৰহেই হোক, তখন তিনি নানান মানুষের মত পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গেও দেখা করে তাকে নানান ধর্ম প্রবচন দেবার পরে, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি দেখতে আমন্ত্রণ করেন। বলাই বাহুল্য বিদ্যাসাগর তখন মিষ্টি কথায় তাঁকে,  'আপনি এলেন আর আমি যাব না!' বললেও কখনোই কালীবাড়ির পথ মাড়াননি। কারণ বিদ্যাসাগরের চলার পথ ছিল যুক্তির ও কর্মের। ভাববাদের ও কুসংস্কারের পঙ্কিল ঘূর্ণাবর্ত থেকে তাঁর শিক্ষিত শীলিত  যৌক্তিক  চেতনা ছিল অনেক দূরের। 


এই পর্বে আমরা শুধুমাত্র উক্ত সাক্ষাৎকারটির ভিত্তিতে  গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের মনোজগতে সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা করব। 

সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা দেখি পদমর্যাদায় ও সম্মানে বড় কোন মানুষকে একজন সাধারণ  মানুষ, যিনি শিক্ষার আলো তেমন পাননি অথবা পদমর্যাদায় অনেক নীচের, তিনি কিভাবে দেখেন?  হয় তিনি উচ্চপদের মানুষটিকে অতিভক্তি দেখাবেন নয়তো তাঁর সামান্য ভুল ত্রুটি খুঁজে নিয়ে তাকে, 'আরে ও তো অতি সাধারণ, এই সামান্য কথাও জানে না!' জাতীয় কথা বলে  নিজেকে তাঁর চেয়ে বড় দেখানোর চেষ্টা করে নিজের অহংপুষ্টি করবেন। এটি গ্ৰাম অঞ্চলে অতি সাধারণ একটি ঘটনা। আমার ঠিক এই মনোবৃত্তিই দেখতে পাব গদাধরের একটি মন্তব্যে। গদাধর, যে কিনা তৎকালীন সমাজে কিছু পৃষ্ঠপোষকের তোল্লাই পেয়ে বেশ একটু পরিচিতি পেয়েছে, তার ইগো বুস্টেড হয়েছে বেশ ভালই! বিদ্যাসাগর কথার কথা 'আপনি এলেন আর আমি যাব না' বলে, না যাওয়ায়, পরিস্কার বলে বসে, 'বিদ্যাসাগর মিথ্যা কথা কয় কেন?'। পাঠক ভেবে দেখুন বিদ্যাসাগর যে কিনা একা হাতে শিক্ষার মশাল নিয়ে তখন সমাজ সংস্কারে, শিক্ষাবিস্তারে, পরের দুঃখনিবারণে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন, তখন তাঁকে সরাসরি "মিথ্যাবাদী" প্রতিপন্ন করে দিতেও এই পূজারী বামুনটির বাধছে না! যেন দক্ষিণেশ্বরে এসে বেশ একটু ধর্মকথা শুনে, সমাজে রামকৃষ্ণ কে আরেকটু পরিচিত করে দিলেই সে সত্যবাদী নাহলেই মিথ্যুক। এখানে হয়তো তার বুঝতে ভুল হয়েছে যে ওটা কেবল কথার কথা নয়ত ধরে নিতে হয় বিদ্যাসাগরের কর্মপরিধি কোন মন্দিরের চৌকাঠ দিয়ে যায় না এই  সামান্য বিষয় বোঝার মত বুদ্ধিও তার ছিল না। যাই হোক, গদাধরের মন্তব্যটি কথামৃতে রয়েছে। 

আগের পর্বে আমরা দেখেছি বিদ্যাসাগর গদাধরকে প্রশ্ন করেছিলেন (কথামৃত অনুযায়ী) -"তিনি কি কাউকে বেশি কাউকে কম শক্তি দিয়েছেন?" তাতে গদাধর জানান, নিশ্চয়ই, নাহলে তোমাকেই বা এত লোকে মানে কেন, 'তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো?' 

পরে কথামৃতে দেখি এই প্রশ্নে গদাধরের ছদ্ম  অহং কিভাবে পুষ্ট হয়েছিল তারই একটি মন্তব্য থেকে।  গদাধর বেশ নিজেই নিজেকে সাবাশ দেবার কায়দায় বলে বসে, "বিদ্যাসাগরের এক কথায় তাকে চিনেছি!” এই জাতীয় গভীর আত্মবিশ্বাস ও তার আত্মম্ভরী ঘোষনা একমাত্র মূর্খের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে কিনা এক কথায় কাউকে চিনে যাবার দাবি করতে পারে! এখানেও সেই পূর্ব কথিত মনস্তত্ব কাজ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে তার মত এক 'অবতার' ধরাধামে নেমে লীলা করছে, 'যেই রাম সেই কৃষ্ণ সেই এই দেহে রামকৃষ্ণ', তাকে কিনা এতখানি উপেক্ষা! নিজে যেচে গিয়ে ডাকলেও না আসা!  নিশ্চয় গদাধরের অহং তীব্র আহত হয়েছিল। তাই কি এতখানি বিষোদগার বিদ্যাসাগরের বিরূদ্ধে? অনুমান করা কঠিন নয়।


আচ্ছা তথাকথিত  'যত মত তত পথ' এর প্রবর্তক হঠাৎ করেই বিদ্যাসাগরের পথটিকে গ্ৰহনযোগ্য মনে করেননি কেন? তার মধ্যে তাহলে আসলে সংকীর্ণতাই ছিল,এমন মনে হয়নি কি? 

পাঠকদের প্রসঙ্গক্রমে তিনটি ঘটনা জানিয়ে বলি - 

ঘটনা ১ :   শ্রীম অর্থাৎ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। একবার বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় বিদ্যাসাগর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি খবর পেয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের কাছে বেশি যাতায়াতের জন্যই শ্রীম বিদ্যালয়ে যথেষ্ট সময় দিতে পারতেন না।  শ্রীম গুরুর অপমান হচ্ছে বুঝে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। ধন্য শিক্ষক বলতে হয়! যার কাছে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল গুরুর সম্মান! 

ঘটনা ২ :  ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বদলে ধর্মশিক্ষা বেশি দিচ্ছেন খবর পেয়ে বিদ্যাসাগর (তাঁর ছাত্রতুল্য)  তাঁর বিদ্যালয়ে কর্মরত নরেন্দ্রনাথ দত্তকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ বিদ্যাসাগরের স্পষ্ট মতামত ছিল শিক্ষকরা অবশ্যই ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকবেন।


ঘটনা ৩:  গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর, তাঁকে নিয়ে কোন অনুষ্ঠান করবেন হলে তার শিষ্যরা বিদ্যাসাগরের কাছে চাঁদা চাইতে যান। সেই বিদ্যাসাগর যিনি অন্যের কষ্টে অনেকসময় অপাত্রেও দান করেছেন, তিনি তাদের একটা টাকাও দেননি।  

নিশ্চয় দেশের যুবসমাজ যাঁদের তিনি চেয়েছিলে আধুনিক শিক্ষিত ও যুক্তিবাদী করে গড়ে তুলতে, তাদের এভাবে পথভ্রান্ত হতে দেখে একজন মানুষ গড়ার কারিগর বিদ্যাসাগর খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। 

এই ঘটনা ও উপরের আলোচনা থেকে বোধহয়  যুক্তিবাদী পাঠকের কাছে এই বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে বিদ্যাসাগরের,তথাকথিত পরমহংস এবং তাদের চেলাদের সম্পর্কে মনোভাব কেমন ছিল। তিনি এই ধর্মের নামে সমাজকে অন্ধকারের দিকে যেতে দেখছিলেন যা তাঁর নিজের সমাজ ও মানবগঠনের পরিপন্থী ছিল। 

কাজেই সাক্ষাৎকারটি চূড়ান্তভাবে  'অসফল' হয়েছিল একথা বলাই বাহুল্য। 


এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গেই কথামৃত গ্ৰন্থটি সম্পর্কে দু'একটা কথা বলা যায়। তথাকথিত শ্রুতিধর শ্রীম র ওপর অভিযোগ তিনি একটি কি দুটি শব্দ থেকে অনেক পত্রপল্লব বিস্তার করেছেন। যাকে সোজা কথায় ফেনানো বলা যায়। এই ফেনানো যে অনেকক্ষেত্রে ভক্তসুলভ এবং সত্যের উলটো দিকে গিয়েছে সেটাও অনুমান করা খুব কঠিন নয়। যেখানে শ্রীমর সমকালীন ভক্তরাই কথামৃতকে খুব trustworthy মনে করতেন না।  রামকৃষ্ণ র কথিত গ্ৰাম্য slang ও গালিগালাজ গুলি  অনেকক্ষেত্রে বাদ গেছে।  নিশ্চিতভাবেই গুরুকে glorify করতে। কথামৃতের পূর্ব সংস্করণে ‘শালার পন্ডিত’ কথাটি ছিল। এখন সেটি অবশ্য edit out হয়েছে। এরকম আরো নানা ক্ষেত্রে। 


বঙ্কিমচন্দ্র র সঙ্গে গদাধরের সাক্ষাৎ বিষয়টিতে প্রথমে শ্রীম নিজ উপস্থিতির কথা বললেও পরের সংস্করণে  তার উপস্থিতি  না থাকার কথা জানান।  কাজেই ঈশ্বরচন্দ্র -গদাধর সাক্ষাৎকারের মন্তব্যগুলি, বিশেষত বিদ্যাসাগরের ভক্তসুলভ আপনি আজ্ঞা জাতীয় মাখোমাখো মন্তব্যগুলি কতখানি সত্যি আর কতখানি রঙচড়ানো তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।

যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে পারম্পর্য ও চরিত্রবিশ্লেষণ করে  ভক্তরচিত কেতাবগুলি পড়লে বিষয়গুলি আরো স্পষ্ট হতে থাকবে। 

পুস্তক সহায়তা - প্রাগুক্ত।

(১) শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত, লেখক- শ্রীম,প্রকাশক-  উদ্বোধন 

(২) কামারের এক ঘা, লেখক- রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, প্রকাশক- পাভলভ ইন্সটিটিউট


ছবি ঋণ - ড্রয়িং অ্যাকাডেমি।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929